ঈশ্বরভাবনা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ব্রাহ্মসমাজের নন, কোনো বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর নন, তিনি উপনিষদের উদার আকাশে স্বমহিমায় প্রকাশমান। তিনি ঈশ্বরকে প্রেম সম্পর্কের মধ্যে দেখেছেন। ঈশ্বরকে পিতার মূর্তিতে দেখাও ব্রাহ্মধর্মের ওপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাবের কারণ। আবার ঈশ্বরকে পিতৃকল্পনার মূলে বৈদিক মন্ত্রের প্রভাবও আছে, ‘পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি নমস্তেহস্ত’। তবে তিনি ঈশ্বরকে ‘মা’ বলেও ডাকতে চেয়েছেন। কারণ পিতা-মাতার স্নেহ সন্তানকে জীবনক্ষেত্রে বিচরণে উপযোগী করে তোলে। ‘বিশ্বপিতা’র ভাবনা থেকেই কবির এই
বিশ্বাস জাগ্রত হয়েছে।
ঈশ্বর ও প্রকৃতিকে তিনি একাত্ম করেছেন। কবির ঈশ্বর মানুষের চোখ দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির চিত্ররাশি দেখে নিয়েছেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অমৃতের পাত্র পূর্ণ করে দিয়ে ঈশ্বর পান করেন নিজেরই সৃষ্টির আনন্দ। কারণ তাঁর সৃষ্ট এই মানুষের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় ঈশ্বরের সব বিচিত্রবাণী। ঈশ্বর মানুষের মধ্যে নিজেকে দান করে নিজেকেই মধুর আনন্দে অবলোকন করে চলেছেন অনন্তকাল। কবির ভাষায় :
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।
তারি সাথে প্রভু মিলিয়া তোমার প্রীতি
জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,
আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।
ঈশ্বর, ভগবান, জীবননাথ একাকার রবীন্দ্র রচনায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও আনন্দ উপলব্ধির মধ্যে আছে ভগবানের অমৃতরসের আস্বাদন। কবির ভাষায় :
‘জীবনে আমার যতো আনন্দ
পেয়েছি দিবসরাত
সবার মাঝারে তোমারে আজিকে
স্মরিব জীবননাথ।...
বার বার তুমি আপনার হাতে
স্বাদে গন্ধে ও গানে
বাহির হইতে পরশ করেছ
অন্তর মাঝখানে।
পিতামাতা ভ্রাতা প্রিয় পরিবার
মিত্র আমার পুত্র আমার
সকলের সাথে হৃদয়ে প্রবেশি
তুমি আছ মোর সাথ।
সব অনন্দ-মাঝারে তোমারে
স্মরিব জীবননাথ।’ (নৈবেদ্য,৭)
তাঁর মতে, ‘যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই।প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য-সম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে।
...বৈষ্ণব ধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে।...’ (পঞ্চভূত, মনুষ্য)
এমন কি জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা
এই ঈশ্বর প্রেম দাস্যভাবযুক্ত নয়। বরং দেখা যায় ঈশ্বর মহাভিক্ষুক বেশে আমাদের কর্ম ও ত্যাগের অর্ঘ্য ভিক্ষা করছেন। ঈশ্বরের এই রূপটির ব্যাখ্যা আছে ‘খেয়ার নেয়ে’, ‘দুলহা’ ও ‘রাজার দুলাল’-এর মধ্যে। এ ধরনের অধ্যাত্ম জীবনের আকুতি আছে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ১২১ সংখ্যক কবিতায় :
‘তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে—
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।’
প্রেমেতেই অসীম সীমার মধ্যে ধরা দিচ্ছে এবং সীমা অসীমকে আলিঙ্গন করছে, তর্কের দ্বারা এর কোনো মীমাংসা করবার জো নেই। মানুষের অনুভূতিকে কবি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রেমের মধ্যে কেবল শান্তি নেই অশান্তিও আছে। প্রেমেই আমরা অনন্তের স্বাদ পাই। সীমার মধ্যে অসীমতার ছায়া ফেলে মৃত্যুকে কিছুতেই স্বীকার করে না প্রেম। প্রেমের সাধনায় সংযম, সুবিবেচনা ও সৌন্দর্য থাকবে। ধর্মসাধনার মূলে প্রেম যে অবশ্য প্রয়োজন তা কবি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন।
নিভৃত চিত্তের মধ্যে নির্জন অবকাশে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার অভ্যাস হচ্ছে ধর্মসাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। নির্জনতা অন্তরে প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।
গীতবিতানে’র পূজাপর্যায় গানের সংখ্যা ৬১৭। এসব গানে অভিব্যক্ত হয়েছে কবির ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা ও আত্মনিবেদনের আকুতি। যেমন একটি গান, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি/ গানের সুরে।’ অথবা ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি তখন তারে জানি।’ গানের ভেতর আছে হৃদয়ের সকল দৈন্য ঢেলে দেবার প্রেরণা, ঈশ্বরকে ভালোবাসার জোয়ারে আবগাহন করার আর্তি, অন্তর্যামীর অপ্রত্যাশিত দানের জন্য তাঁর চরণ স্পর্শ করে থাকার আকাঙ্ক্ষা। সরল, মর্মস্পর্শী অন্তর্যামীর প্রতি নিবেদিত এরকম পঙ্ক্তিমালা হলো :
‘সংসার যবে মন কেড়ে লয় জাগেনা যখন প্রাণ
তখন হে নাথ প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান।
অন্তরযামী ক্ষমো সে আমার শূন্য প্রাণের বৃথা উপহার
পুষ্পবিহীন পূজার আয়োজন ভক্তিবিহীন তান।
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে আশা করি প্রাণপণে
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে আসে মনে
সহসা একদা আপনা হইতে ভার দিবে তুমি তোমার অমৃতে
এই ভরসায় করি পদতলে শুষ্ক হৃদয় দান।’
শান্তিনিকেতনের মন্দিরে প্রত্যুষ ও সান্ধ্য উপাসনায় অনেকগুলো গান গাওয়া হতো। এমনকি পৌষোৎসবের উদ্বোধনের সময় কবির উপাসনার পর আশ্রম বিদ্যালয়ের বালকরা কবির গান গাইত। একটি বর্ণনা, ‘প্রথম সংগীতের পর এবং স্বাধ্যায়ের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ব্রহ্মসংগীতাবলী হইতে একটি গান গাহিলেন। সংগীতটি যেন উৎসব-উৎসকে একেবারে খুলিয়া দিল।