'গীতাঞ্জলি' হিসাবে প্রকৃতি চেতনা- রবীন্দ্রনাথ
গীতাঞ্জলির ১২০-এ আছে ‘
সীমার মাঝে অসীম তুমি/
বাজাও আপন সুর/
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
/ তাই এত মধুর।’
জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ।’
গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে। আস্তিক্য অনুভূতির গভীর ঐকান্তিকতা লক্ষণীয় :
‘
এই তো তোমার প্রেম ওগো
হৃদয় হরণ।
এই যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।। ’
প্রকৃতি ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন।
নৈবদ্যের ৩০ সংখ্যক (‘মুক্তি’) কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন।
‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।...
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’
জীবনীর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেদনা বহন করতে হয়েছে; মৃত্যুশোক ও দুঃখের পীড়নে পীড়িত হতে হয়েছে। নিদারুণ শোকাঘাতে তিনি স্তব্ধ হয়েছেন। শোকাঘাতের কষ্ট দূর করার জন্য শান্তিনিকেতনের মন্দির-তোরণে ভোরের আলো-অন্ধকারে কবি ধ্যানে বসতেন।
তবে শোকাঘাতে উজ্জ্বল হয়েছে কবির পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন,
“নৈবেদ্যের দেবতা দূরে থাকিয়া পূজার্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, ‘।
খেয়ার নেয়ে’ আলোছায়ার রহস্যলোকে অস্পষ্টভাবে ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিয়াছেন,
আর গীতাঞ্জলির দেবতা ভক্তের সম্মুখে আসীন।
শান্তিনিকেতনের ধ্যানলব্ধ সাধনার মধ্যে গীতাঞ্জলির রসানুভূতির প্রতিষ্ঠা।
মূলত আমরা সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে জগৎকে পাই।বিশ্বজোড়া বিচিত্র শব্দ ও সুরের মধ্য দিয়ে সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে বিশ্বের সর্ব উপাদানকে উপভোগ করা কবির ধর্ম
। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে যোগযুক্ত থেকে ঐক্যানুভূতি করতে হয়।
‘দ্রষ্টা’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন, ‘এই বিশ্বসংসারে এমন কিছুই নেই, একটি কণাও নেই, যার মধ্যে পরমাত্মা ওতপ্রোত হয়ে না রয়েছেন।’
এই ব্রহ্মময় সর্বজগতের কথা তাঁর আধ্যাত্মিকতার বিশিষ্ট রূপ। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘
প্রকৃতিতে শক্তির দ্বারা পরমাত্মা নিজেকে প্রচার করছেন আর প্রেমের দ্বারা জীবাত্মায় তিনি নিজেকে দান করছেন।’ (প্রকৃতি)
প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে যা শক্তি ও নিয়ম, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তা ভক্তি ও লীলা বা আনন্দ।
এই প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিকতার সামঞ্জস্য চেয়েছেন কবি।
উপরন্তু প্রকৃতির পরমাশ্চর্য রহস্যকেও মেনে নিতে হবে। বিশ্বপ্রকৃতি ও অন্তরপ্রকৃতির নিয়মের মিলন হলে শান্তি জন্মে মানব হৃদয়ে।
তাই গীতাঞ্জলিতে প্রকৃতি চেতনায় বিভোর কবি রবীন্দ্রনাথ।

No comments:
Post a Comment