দুঃখের গান - রবীন্দ্র সাহিত্য।
দুঃখের গান টপিক ঃ
কবির আত্মদর্শন বা পরমার্থচেতনা বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের ৪১ সংখ্যক কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি।
দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়।
গীতবিতানের পূজা পর্বের ৯১ সংখ্যক গানে আছে,
‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।
...মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে
/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।’
কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়।
খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ।
দুঃখকে আহ্বান করার গান।
‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’-
দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়।
বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত।
চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ।
একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির ৬৭ গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়।
দুঃখবোধ : পাপের প্রসঙ্গের চেয়ে দুঃখ ও দুঃখবোধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক কথা বলেছেন। তাঁর বহু গানের মূল সুর দুঃখ। তাঁর মতে, ‘দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে... এবং এই বৃহত্ত্বেই মানুষকে আনন্দের অধিকারী করিয়া তোলে। ...মনুষ্যত্ব পরম দুঃখের ধন,... দুঃখবোধের সহিত নিরন্তর সংগ্রামে যে আত্মার সমস্ত শক্তি জাগ্রত - সেই আত্মাই ব্রহ্মকে যথার্থভাবে লাভ করিবার উদ্যম প্রাপ্ত হয়।’ (মনুষ্যত্ব)
আত্মার প্রসার লাভের বাধা থেকে দুঃখের উদ্ভব। ইউনিভার্সাল ল বা বিশ্ব বিধানের সঙ্গে আমাদের ইচছা ও কর্মকে মেলানোর নামই হচ্ছে ‘আত্মার সম্প্রসারণ’। নিজের ইচ্ছা ও কর্ম বাধাগ্রস্ত হলে বুঝতে হবে বিশ্বধর্ম কোনোভাবে ব্যাহত হয়েছে; নিজের ইচ্ছা বিশ্ব ইচ্ছার সঙ্গে সুর মিলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্যই আমাদের পথে পথে বাধা। এ কারণে আসক্তি পরিহার করে আমাদের কর্ম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আত্মদানের মধ্য দিয়ে মঙ্গল অন্বেষণ এবং ত্যাগের মাধ্যমে আত্মার আনন্দ খুঁজে ফেরা অধ্যাত্মসাধনার অংশ। ব্রহ্মা বা যিনি বৃহৎ তাঁর মধ্যে সমর্পিত হলে তবে সেই ত্যাগ পরিপূর্ণতার মধ্যেই সার্থক হয়। আর এই ত্যাগের দ্বারা প্রেমকে পাওয়া যায়।

No comments:
Post a Comment