Search

Tuesday, December 13, 2022

দুঃখের গান - রবীন্দ্রনাথ

 দুঃখের গান - রবীন্দ্র সাহিত্য। 


দুঃখের গান টপিক ঃ

কবির আত্মদর্শন বা পরমার্থচেতনা বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের ৪১ সংখ্যক কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। 

দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। 

গীতবিতানের পূজা পর্বের ৯১ সংখ্যক গানে আছে,
 ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।
...মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে
/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।’ 

কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়। 

খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ।


দুঃখকে আহ্বান করার গান। 
 ‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’- 

দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়।

বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত।

 চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ।

 একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির ৬৭ গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়।



দুঃখবোধ : পাপের প্রসঙ্গের চেয়ে দুঃখ ও দুঃখবোধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক কথা বলেছেন। তাঁর বহু গানের মূল সুর দুঃখ। তাঁর মতে, ‘দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে... এবং এই বৃহত্ত্বেই মানুষকে আনন্দের অধিকারী করিয়া তোলে। ...মনুষ্যত্ব পরম দুঃখের ধন,...  দুঃখবোধের সহিত নিরন্তর সংগ্রামে যে আত্মার সমস্ত শক্তি জাগ্রত - সেই আত্মাই ব্রহ্মকে যথার্থভাবে লাভ করিবার উদ্যম প্রাপ্ত হয়।’ (মনুষ্যত্ব)

আত্মার প্রসার লাভের বাধা থেকে দুঃখের উদ্ভব। ইউনিভার্সাল ল বা বিশ্ব বিধানের সঙ্গে আমাদের ইচছা ও কর্মকে মেলানোর নামই হচ্ছে ‘আত্মার সম্প্রসারণ’।  নিজের ইচ্ছা ও কর্ম বাধাগ্রস্ত হলে বুঝতে হবে বিশ্বধর্ম কোনোভাবে ব্যাহত হয়েছে; নিজের ইচ্ছা বিশ্ব ইচ্ছার সঙ্গে সুর মিলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্যই আমাদের পথে পথে বাধা। এ কারণে আসক্তি পরিহার করে আমাদের কর্ম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আত্মদানের মধ্য দিয়ে মঙ্গল অন্বেষণ এবং ত্যাগের মাধ্যমে আত্মার আনন্দ খুঁজে ফেরা অধ্যাত্মসাধনার অংশ। ব্রহ্মা বা যিনি বৃহৎ তাঁর মধ্যে সমর্পিত হলে তবে সেই ত্যাগ পরিপূর্ণতার মধ্যেই সার্থক হয়। আর এই ত্যাগের দ্বারা প্রেমকে পাওয়া যায়।
 

Sunday, December 11, 2022

গীতাঞ্জলি প্রকৃতি চেতনা - রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য

'গীতাঞ্জলি' হিসাবে প্রকৃতি  চেতনা- রবীন্দ্রনাথ


গীতাঞ্জলির ১২০-এ আছে ‘
সীমার মাঝে অসীম তুমি/ 
বাজাও আপন সুর/ 
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
/ তাই এত মধুর।’ 

জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ।’


 গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে। আস্তিক্য অনুভূতির গভীর ঐকান্তিকতা লক্ষণীয় :

এই তো তোমার প্রেম ওগো
হৃদয় হরণ।
এই যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।। ’

প্রকৃতি ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন।
 নৈবদ্যের ৩০ সংখ্যক (‘মুক্তি’) কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন। 
‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।...
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’


জীবনীর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেদনা বহন করতে হয়েছে; মৃত্যুশোক ও দুঃখের পীড়নে পীড়িত হতে হয়েছে। নিদারুণ শোকাঘাতে তিনি স্তব্ধ হয়েছেন। শোকাঘাতের কষ্ট দূর করার জন্য শান্তিনিকেতনের মন্দির-তোরণে ভোরের আলো-অন্ধকারে কবি ধ্যানে বসতেন। 

তবে শোকাঘাতে উজ্জ্বল হয়েছে কবির পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবন। 


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, 

“নৈবেদ্যের দেবতা দূরে থাকিয়া পূজার্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, ‘।
খেয়ার নেয়ে’ আলোছায়ার রহস্যলোকে অস্পষ্টভাবে ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিয়াছেন, 
আর গীতাঞ্জলির দেবতা ভক্তের সম্মুখে আসীন।

 শান্তিনিকেতনের ধ্যানলব্ধ সাধনার মধ্যে গীতাঞ্জলির রসানুভূতির প্রতিষ্ঠা।



মূলত আমরা সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে জগৎকে পাই।বিশ্বজোড়া বিচিত্র শব্দ ও সুরের মধ্য দিয়ে সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে বিশ্বের সর্ব উপাদানকে উপভোগ করা কবির ধর্ম
। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে যোগযুক্ত থেকে ঐক্যানুভূতি করতে হয়। 

‘দ্রষ্টা’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন, ‘এই বিশ্বসংসারে এমন কিছুই নেই, একটি কণাও নেই, যার মধ্যে পরমাত্মা ওতপ্রোত হয়ে না রয়েছেন।’ 

এই ব্রহ্মময় সর্বজগতের কথা তাঁর আধ্যাত্মিকতার বিশিষ্ট রূপ। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘
প্রকৃতিতে শক্তির দ্বারা পরমাত্মা নিজেকে প্রচার করছেন আর প্রেমের দ্বারা জীবাত্মায় তিনি নিজেকে দান করছেন।’ (প্রকৃতি) 

প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে যা শক্তি ও নিয়ম, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তা ভক্তি ও লীলা বা আনন্দ। 

এই প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিকতার সামঞ্জস্য চেয়েছেন কবি। 
উপরন্তু প্রকৃতির পরমাশ্চর্য রহস্যকেও মেনে নিতে হবে। বিশ্বপ্রকৃতি ও অন্তরপ্রকৃতির নিয়মের মিলন হলে শান্তি জন্মে মানব হৃদয়ে।


তাই গীতাঞ্জলিতে প্রকৃতি চেতনায় বিভোর কবি রবীন্দ্রনাথ। 

Saturday, December 10, 2022

ঈশ্বরভাবনা - রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য

 ঈশ্বরভাবনা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ব্রাহ্মসমাজের নন, কোনো বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর নন, তিনি উপনিষদের উদার আকাশে স্বমহিমায় প্রকাশমান। তিনি ঈশ্বরকে প্রেম সম্পর্কের মধ্যে দেখেছেন। ঈশ্বরকে পিতার মূর্তিতে দেখাও ব্রাহ্মধর্মের ওপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাবের কারণ। আবার ঈশ্বরকে পিতৃকল্পনার মূলে বৈদিক মন্ত্রের প্রভাবও আছে, ‘পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি নমস্তেহস্ত’। তবে তিনি ঈশ্বরকে ‘মা’ বলেও ডাকতে চেয়েছেন। কারণ পিতা-মাতার স্নেহ সন্তানকে জীবনক্ষেত্রে বিচরণে উপযোগী করে তোলে। ‘বিশ্বপিতা’র ভাবনা থেকেই কবির এই




বিশ্বাস জাগ্রত হয়েছে।  
ঈশ্বর ও প্রকৃতিকে তিনি একাত্ম করেছেন। কবির ঈশ্বর মানুষের চোখ দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির চিত্ররাশি দেখে নিয়েছেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অমৃতের পাত্র পূর্ণ করে দিয়ে ঈশ্বর পান করেন নিজেরই সৃষ্টির আনন্দ। কারণ তাঁর সৃষ্ট এই মানুষের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় ঈশ্বরের সব বিচিত্রবাণী। ঈশ্বর মানুষের মধ্যে নিজেকে দান করে নিজেকেই মধুর আনন্দে অবলোকন করে চলেছেন অনন্তকাল। কবির ভাষায় :
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।
তারি সাথে প্রভু মিলিয়া তোমার প্রীতি
জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,
আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।
ঈশ্বর, ভগবান, জীবননাথ একাকার রবীন্দ্র রচনায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও আনন্দ উপলব্ধির মধ্যে আছে ভগবানের অমৃতরসের আস্বাদন। কবির ভাষায় :
‘জীবনে আমার যতো আনন্দ
পেয়েছি দিবসরাত
সবার মাঝারে তোমারে আজিকে
স্মরিব জীবননাথ।...
বার বার তুমি আপনার হাতে
স্বাদে গন্ধে ও গানে
বাহির হইতে পরশ করেছ
অন্তর মাঝখানে।
পিতামাতা ভ্রাতা প্রিয় পরিবার
মিত্র আমার পুত্র আমার
সকলের সাথে হৃদয়ে প্রবেশি
তুমি আছ মোর সাথ।
সব অনন্দ-মাঝারে তোমারে
স্মরিব জীবননাথ।’ (নৈবেদ্য,৭)


তাঁর মতে, ‘যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই।প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য-সম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে।

 ...বৈষ্ণব ধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে।...’ (পঞ্চভূত, মনুষ্য)

এমন কি জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা

এই ঈশ্বর প্রেম দাস্যভাবযুক্ত নয়। বরং দেখা যায় ঈশ্বর মহাভিক্ষুক বেশে আমাদের কর্ম ও ত্যাগের অর্ঘ্য ভিক্ষা করছেন। ঈশ্বরের এই রূপটির ব্যাখ্যা আছে ‘খেয়ার নেয়ে’, ‘দুলহা’ ও ‘রাজার দুলাল’-এর মধ্যে। এ ধরনের অধ্যাত্ম জীবনের আকুতি আছে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ১২১ সংখ্যক কবিতায় :
‘তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে—
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।’
প্রেমেতেই অসীম সীমার মধ্যে ধরা দিচ্ছে এবং সীমা অসীমকে আলিঙ্গন করছে, তর্কের দ্বারা এর কোনো মীমাংসা করবার জো নেই। মানুষের অনুভূতিকে কবি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রেমের মধ্যে কেবল শান্তি নেই অশান্তিও আছে। প্রেমেই আমরা অনন্তের স্বাদ পাই। সীমার মধ্যে অসীমতার ছায়া ফেলে মৃত্যুকে কিছুতেই স্বীকার করে না প্রেম। প্রেমের সাধনায় সংযম, সুবিবেচনা ও সৌন্দর্য থাকবে। ধর্মসাধনার মূলে প্রেম যে অবশ্য প্রয়োজন তা কবি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন।


নিভৃত চিত্তের মধ্যে নির্জন অবকাশে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার অভ্যাস হচ্ছে ধর্মসাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। নির্জনতা অন্তরে প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।




গীতবিতানে’র পূজাপর্যায় গানের সংখ্যা ৬১৭। এসব গানে অভিব্যক্ত হয়েছে কবির ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা ও আত্মনিবেদনের আকুতি। যেমন একটি গান, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি/ গানের সুরে।’ অথবা ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি তখন তারে জানি।’ গানের ভেতর আছে হৃদয়ের সকল দৈন্য ঢেলে দেবার প্রেরণা, ঈশ্বরকে ভালোবাসার জোয়ারে আবগাহন করার আর্তি, অন্তর্যামীর অপ্রত্যাশিত দানের জন্য তাঁর চরণ স্পর্শ করে থাকার আকাঙ্ক্ষা। সরল, মর্মস্পর্শী অন্তর্যামীর প্রতি নিবেদিত এরকম পঙ্ক্তিমালা হলো :
‘সংসার যবে মন কেড়ে লয় জাগেনা যখন প্রাণ
তখন হে নাথ প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান।
অন্তরযামী ক্ষমো সে আমার শূন্য প্রাণের বৃথা উপহার
পুষ্পবিহীন পূজার আয়োজন ভক্তিবিহীন তান।
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে আশা করি প্রাণপণে
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে আসে মনে
সহসা একদা আপনা হইতে ভার দিবে তুমি তোমার অমৃতে
এই ভরসায় করি পদতলে শুষ্ক হৃদয় দান।’
শান্তিনিকেতনের মন্দিরে প্রত্যুষ ও সান্ধ্য উপাসনায় অনেকগুলো গান গাওয়া হতো। এমনকি পৌষোৎসবের উদ্বোধনের সময় কবির উপাসনার পর আশ্রম বিদ্যালয়ের বালকরা কবির গান গাইত। একটি বর্ণনা, ‘প্রথম সংগীতের পর এবং স্বাধ্যায়ের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ব্রহ্মসংগীতাবলী হইতে একটি গান গাহিলেন। সংগীতটি যেন উৎসব-উৎসকে একেবারে খুলিয়া দিল। 

Friday, December 9, 2022

আধ্যাত্নিকতা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে

রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা সর্বজনীন

আধ্যাত্মিক সাধনা কখনোই রূপসাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। ইন্দ্রিয়গোচর যে কোনো বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ)

‘আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না, আমাদের ঔদাসীন্য আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয়। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তাঁর আনন্দরূপ।’ (শান্তিনিকেতন)


অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘আধ্যাত্মিক সাধনা’ অরূপের সাধনা; সাধকরা বস্তু পৃথিবীর বাইরে অতীন্দ্রিয় জগতের অনুসন্ধান করেন সেই সাধনায়। ‘আধ্যাত্মিকতা’ আমাদের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এর মাধ্যমে তাঁর আনন্দরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী কিংবা সাধক ছিলেন না। তিনি সুফিধারাসহ অন্য মরমিয়াদের মতো অধ্যাত্মসাধনায় নিমগ্নও হননি।

তবে তাঁর সমগ্র চেতনার মধ্যে একটা নিগূঢ় অধ্যাত্ম-অনুভূতি ছিল— সেই অনুভূতিই তাঁর শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাব্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাঁর খেয়া-গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি কাব্য এবং অন্যান্য রচনায় অধ্যাত্মচেতনা প্রকাশিত। তবে তার আগে আধ্যাত্মিকতা ও সার্বজনীনতা সম্পর্কে আলোকপাত করা যেতে পারে।

প্রবন্ধের সূচনায় উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণ রেখেই বলতে হয়, আধ্যাত্মিকতা বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝানো হয় যা আমাদের প্রতিদিনের স্থূলতা থেকে অনেক দূরের। এটি হচ্ছে সেই গহিন পথ যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। 
ধ্যান, প্রার্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তরজীবনের উন্নতি হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার বাস্তবতা হতে পারে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং এই সংযোগ ব্যক্তি থেকে প্রসারিত হতে পারে মানব সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত।

        জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থসাধনা। যে বিশ্বাস ধারণ করে ঈশ্বর সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতা তারই নাম কি আধ্যাত্মিকতা?
প্রচলিত ধারণায় আধ্যাত্মিকতা বা পরমার্থসাধনাকে ধর্মীয় জীবনেরই অংশ বলা হয়। 

অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকায় এ শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান’ অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন। এ ধরনের দৃষ্টিকোণে আধ্যাত্মিকতা বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি ইত্যাদি। 

অনেকে মনে করেন এসব বিবেচনা কোনো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিদিনকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যম এখানে কিংবা আমাদের মৃত্যুর পরে কী হবে, এসব ভাবনাই অধ্যাত্মতত্ত্বের অংশ। 

আমরা তখনই আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিত হই যখন সুন্দর, প্রেম অথবা সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে খুঁজে পাই।
বাস্তব পৃথিবীতে জীবন পরিচালনায় আমাদের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় সূক্ষ্ম সম্পর্কের সুতোয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে পরমার্থ-জীবন আমাদের প্রশান্তি দান করে।

 আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন, ধর্মীয় গ্রন্থে নিমগ্ন হওয়াকে চিহ্নিত করা হয় এর অন্যতম পথ। 

আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে।

ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার যোগাযোগটা কী রকমের? পরমের সন্ধানে নিয়োজিত আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্য পরমের সন্ধান আর ঈশ্বরের অন্বেষণ ধর্মের মূল কাজ। 

তবে ধর্মের থাকে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাসের কেন্দ্র। যার সঙ্গে অলৌকিক ও পরমলোকের যোগাযোগ। অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার জন্য নির্দিষ্টভাবে ধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস না থাকলেও চলে। তবে আমাদের মতে আধ্যাত্মিকতা ধর্মেরই একটি অংশ। ধর্মের বাইরে একজন ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক জীবন খুঁজে পেতে পারেন।

 কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রসঙ্গ আলোচনা করলে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা একই জিনিস মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অপরের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করা, নিজের শান্তি, নিজের তৃপ্তি, সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় দান-ধ্যান-প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকা এসবই আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজড়িত। 
এর সঙ্গে বিশ্বাস এবং অলৈাকিকতার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিজের অন্তরের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। আধ্যাত্মিকতা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত। 

আধ্যাত্মিকতাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘পবিত্রতার স্মারক’। পূজা ও নৈবেদ্যের মধ্যে সেই স্মারক লুকিয়ে থাকতে পারে।

অন্যদিকে সার্বজনীন চেতনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে মিত্রতার বিষয়টি।

 

 বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধ্যাত্মিক সত্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সার্বজনীন চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক।


‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৮-৯), ‘ধর্ম’ (১৩১৫) এবং ‘মানুষের ধর্ম’ (১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার দলিল।
অন্যদিকে ‘গীতাঞ্জলি’সহ অনেক কাব্যের মৌল অনুষঙ্গ অধ্যাত্মবাদ।

 প্রথম তিনটি গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো কবির ধর্মোপদেশের সংগ্রহ কিংবা শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনের পরে রচিত। তিনি সাধারণের কাছে ধর্মতত্ত্বের কথা বলেছেন সহজ অনুভবের প্রান্ত থেকে।
অন্যদিকে কবির যথার্থ আধ্যাত্মিক সংগীতের পালা শুরু হয় ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বে।

 । প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনার আদর্শ কবির নিজের জীবনের পূর্ণতার জন্য কেবল নয়, বৃহত্তর হিন্দুসমাজের জীবনযাত্রার জন্য আবশ্যক মনে করেছিলেন। এ জন্য ব্যক্তিগত অধ্যাত্মসাধনার চেয়ে সমাজগত ধর্মসাধনার দিকেই তাঁর দৃষ্টি বেশি পরিমাণে আকৃষ্ট হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জন্মভূমি হিসেবে যথাক্রমে তিনটি স্থান, অর্থাৎ পৃথিবী, স্মৃতিলোক এবং আত্মিকলোককে নির্দিষ্ট করেছেন তাঁর ‘মানবসত্য’ (মানুষের ধর্ম) প্রবন্ধে।

 ‘আত্মিকলোক’কে তিনি বলেছেন, ‘সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ’। 

অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যোগের ক্ষেত্র এই চিত্তলোক। উপরন্তু এই চিত্তলোক বিশ্বগত হলেই মানুষ সত্যের জন্য প্রাণ দিতে উৎসুক হয়ে ওঠে। সর্বমানবের চিত্তের উপস্থিতির কারণে মানুষ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। 
সর্বমানবসত্তা পরস্পর যোগযুক্ত এই ভাবনা মানুষের পরমার্থ চিন্তার অংশ। অর্থাৎ সমস্ত জীবজগতের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ, করুণা, নিঃস্বার্থপরতা, পরহিতব্রত কাজ এবং নিজের জীবনের প্রশান্তিকে অধ্যাত্মবাদের বৈশিষ্ট্য বলা যায়। 



‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারে
শুধু এইটুকু জানি— তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।...’

মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’।

 মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানুষের ধর্ম।


 কবির এই রসের ধর্ম গীতাঞ্জলি গীতিমাল্য ও গীতালিতে স্তরে স্তরে গভীর হইতে গভীরে গিয়া পূর্ণতা লাভ করিয়াছে।” (রবীন্দ্রজীবনী ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৫)


স্মরণীয়, কবির আধ্যাত্মিক আকুতি কেবল প্রবন্ধ ও গীতধারায় নতুনরূপ পরিগ্রহ করেনি তা ‘শারদোৎসব, অচলায়তন, রাজা, ডাকঘর’ নাটকে রূপায়িত। 
প্রতীকী নাটকে কবির আধ্যাত্মিক সংগ্রামের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। 

কবির আধ্যাত্মিক সাধনা সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনীকার বলেছেন, ‘
           তাঁহার আধ্যাত্মিক সাধনা বেদ ও ব্রাত্যকে লইয়া পরিপূর্ণ। তিনি সংস্কৃতির দুই চরম কোটিকে জ্ঞান ও প্রেমের দ্বারা আপনার মধ্যে অর্থপূর্ণ করিয়া নবীন ধারায় নূতন দর্শনতত্ত্বের বুনিয়াদ করিয়াছেন।
’ (পৃ. ৪৬৫)  



কবির অধ্যাত্মচেতনা ও তার সার্বজনীন রূপ সম্পর্কে আলোচনায় কয়েকটি প্রসঙ্গ এখানে তুলে ধরা হলো।

ক) আত্মা : আধ্যাত্মিকতা বিবেচনায় ‘আত্মা’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথের মতে,
  (মানুষের ধর্ম) গ্রন্থে বলছেন,
‘আত্মা’ অমর। মরণধর্মী আমিত্বের মধ্য দিয়ে আত্মার প্রবাহ ও প্রকাশ হয়। ‘আত্মার পরাজয় নাই, ক্ষয় নাই, বিনাশ নাই, মৃত্যু নাই’। 
(ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার মহান বাণী।)


অন্যদিকে ‘আত্মার দৃষ্টি’ রচনায় কবি বলেছেন,
এখানে তিনি চেতনা ও আত্মাকে এক করে দেখেছেন তা হলো...

 ‘আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তার দ্বারাই অনুভব করি, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বুদ্ধির দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নয়। সেই পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চর্য ব্যাপার।’




তবে আধ্যাত্মিকতায় সর্বত্রই আত্মা প্রসারিত হওয়ার অন্তরায় আছে। আত্মাকে সর্বত্র উপলব্ধি হচ্ছে মনের জাগ্রত অবস্থা। আত্মাকে বিশ্বকর্মা বা বিরাটপুরুষের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

 কবির মতে
 আত্মা পরমাত্মা পরম মিলনে বিশ্বজগৎ সম্মিলিত। তখন স্বার্থবিহীন করুণা, ঔদ্ধত্যবিহীন ক্ষমা, অহংকারবিহীন প্রেম- তখন জ্ঞানভক্তিকর্মে বিচ্ছেদবিহীন পরিপূর্ণতা। 
আত্মার ধারণার সঙ্গে ‘সোহহম তত্ত্ব’ জড়িত। আত্মার যে যোগ বা বিশ্বানুভূতি তাই ‘সোহহম তত্ত্ব’।
তাঁর মতে ‘সোহহম’ সমস্ত মানুষের সম্মিলিত অভিপ্রায় মন্ত্র। 
পাপের বাধাকে অতিক্রম করে, দুঃখ ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মার সাধনাকে অগ্রসর করাতে হবে। 

তা ছাড়া ‘আত্মাতে পরমাত্মাকে দর্শন’- উপনিষদের এই ভাব রবীন্দ্রনাথের চেতনায় সক্রিয় ছিল।

গতিশীল মৃত্যু আমাদের অধ্যাত্ম ভাবনাকে তীব্র করে তোলে। 
’ মৃত্যুকে তিনি কবিতায় বলেছেন,
‘ওরে মৃত্যু জানি তুই যুগে যুগে উড়াইয়া আপনার/ দৃঢ় পক্ষভাব।’ 
(মৃত্যু)  

খ) ব্রহ্ম : উপনিষদের ব্রহ্মই কবির ব্রহ্ম। তিনি ‘ধর্মের সরল আদর্শে’ লিখেছেন, 
‘তিনি অন্তরে বাইরে সর্বত্র; তিনি অন্তরতম, তিনি সুদূরতম। তাঁহার সত্যে আমরা সত্য, তাঁহার আনন্দে আমরা ব্যক্ত।’ 



 আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সজাগ থাকতে হবে এভাবে, ‘আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন লাভের প্রধান অন্তরায় হইতেছে। যে আমরা প্রতিদিনের তুচ্ছ ব্যবহারকে অগ্রাহ্য করি; কিন্তু ছোটখাটো বিষয়ও ধর্মসাধনায় তাচ্ছিল্যের ব্যাপার নহে; প্রকৃতির সঙ্গে এবং মানুষের ব্যবহারে প্রত্যহ ছোটখাটো কত অসত্য অন্যায়ই আমরা করি, সেদিকে দৃষ্টি না গেলে সত্যসাধনা সম্পূর্ণ হয় না। যে ব্যক্তি নির্বিশেষের ধ্যানে অধ্যাত্মজীবন লাভের প্রয়াসী তাহাকে দৃশ্যমান শব্দায়মান বিশ্বচরাচরের বৈশিষ্ট্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সম্ভোগ করিতেই হইবে নতুবা তাহার সাধনা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।’ (রবীন্দ্রজীবনী, পৃ. ২৫২)

ঘ) পাপ : আধ্যাত্মিক জীবনে সূক্ষ্ম অসূক্ষ্ম পাপ আছে। পাপ সব সময় বিড়ম্বনার কারণ হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে সংজ্ঞা নির্ণয় না করে বলেছেন, ‘যা অনিত্য, বিশেষ সাময়িক প্রয়োজনে বিশেষ স্থানে যার প্রয়োজন তাকেই বলা হয় পাপ।’ অর্থাৎ যাকে যথাসময়ে বাইরে থেকে মরতে দেওয়া উচিত ছিল, তাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে রাখাই নিজের হাতে পাপকে সৃষ্টি করা হয়। তবে কবি পাপবোধ সম্পর্কে ‘ধর্মের সরল আদর্শ’ ভাষণে কথা বলেছেন। হিন্দুশাস্ত্রে পাপের প্রতি অমনোযোগের কথাও লিখেছেন। তবে তাঁর মতামত নিয়ে দ্বিমত আছে। কারণ হিন্দুশাস্ত্রে পাপবোধ না থাকলে এতো প্রায়শ্চিত্ত ও পুণ্যের ধারণা কেন এবং কোথা থেকে এলো?


চ) প্রেম : রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, বিশ্বলোক ও মানবপ্রেমের কথা।

ছ) উপাসনা : আধ্যাত্মিকতার অনুকূলে জীবনে যে পরিবর্তন ঘটে তার মূলে আছে উপাসনা। রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন উপাসনা করতেন। বিশেষ মন্ত্রকে ধ্যান করতেন। ‘গায়ত্রী মন্ত্র’ এবং ‘শান্তং শিবমদ্বৈতম’ মন্ত্র জপ করতেন গভীর শান্তি ও মঙ্গলের মধ্যে মন প্রবেশ করানোর জন্য। বিশেষ দিন নয়, প্রতিদিনই তিনি কিছু কিছু সম্বল জমাতেন। তিনি নিত্য উপাসনাশীল ছিলেন, তাঁর অন্তরে চির উৎসব ছিল।

প্রার্থনা : 

রবীন্দ্র-অধ্যাত্মবাদে প্রার্থনা অর্থ ‘যাচঞা’ নয়। দুই ইচ্ছার মাঝখানের সেতু হচ্ছে প্রার্থনা। ব্যক্তিগত ইচ্ছার সঙ্গে বিশ্বগত মঙ্গল ইচ্ছার যোগযুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে প্রার্থনা। ভক্তি ও প্রীতির বলে মানুষ বুঝতে পারে ঈশ্বর রসস্বরূপ। ভক্তি বিশ্বাস আত্মসমর্পণ ইচ্ছা হে প্রেম একাত্ম। কবি বলেছেন, ‘আমাদিগকে যাহা কিছু দিবার তাহা আমাদের প্রার্থনার বহু পূর্বেই দেওয়া হইয়া গেছে। আমাদের যথার্থ ইপ্সিত ধনের দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত। বাকি আছি কেবল লইবার চেষ্টা, তাহাই যথার্থ প্রার্থনা।’ (প্রার্থনা, ধর্ম) জীবনের মধ্যে সত্যের প্রকাশ, জ্যোতির প্রকাশ, অমৃতের প্রকাশই প্রার্থনায় সম্ভব।
ঝ) ধ্যান : 

ঞ) জীবনদেবতা : ‘জীবনদেবতা’র ভাবনাকেও রবীন্দ্রনাথের অতীন্দ্রিয় দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কারণ ‘জীবনদেবতা’ সম্পর্কে কবির ব্যাখ্যা তাঁর পরমার্থচেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রবীন্দ্রজীবনীকার বলেছেন, ‘আসলে কবিজীবনে বোধি ও বোধের উৎসস্থল ধ্যানক্ষেত্র; ধ্যানের সেই তৃতীয় নেত্রে জীবনদেবতা ও বিশ্বদেবতা এক বিশ্বাত্মা, যাহাকে সাধকরা বলিয়াছেন সোহহং তত্ত্ব। কবিতার মধ্যে জীবনদেবতা তত্ত্ব— দ্বৈতভাবে জীবাত্মার প্রকাশ সেখানে; কবির ‘ধর্মা’দি গ্রন্থে দ্বৈতাদ্বৈতভাবে পরমাত্মার এবং ‘মানুষের ধর্মে’ বিশ্বাত্মার সোহহং তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে।’ (পৃ. ৪৫৯) এ সম্পর্কে কবির মন্তব্য, ‘ধর্মশাস্ত্রে যাঁহাকে ঈশ্বর বলে তিনি বিশ্বলোকের, আমি তাঁহার কথা বলি নাই; যিনি বিশেষ রূপে আমার... যিনি ছাড়া আর কেহ এবং কিছুই আমাকে আনন্দ দিতে পারে না, চিত্রা কাব্যে তাঁহারই কথা আছে। যে শক্তি আমার জীবনের সমস্ত সুখদুঃখকে সমস্ত ঘটনাকে ঐক্যদান তাৎপর্যদান করিতেছে, আমার রূপরূপান্তর জন্মজন্মান্তরকে একসূত্রে গাঁথিতেছে, যাহার মধ্য দিয়া বিশ্বচরাচরের মধ্যে ঐক্য অনুভব করিতেছি, তাহাকেই 

জীবনদেবতা নাম দিয়া লিখিয়াছিলাম :
‘ওহে অন্তরতম,
মিটিছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম।’ 

জীবনদেবতাকে পেয়ে কবির আধ্যাত্মিক বোধ দেবসত্তার সঙ্গে মানবচেতনাকে, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবকে, নিত্যের সঙ্গে অনিত্যকে এবং কবিসত্তার সঙ্গে কর্মীসত্তাকে মিলিতভাবে দেখতে পেয়েছে। অন্তর্যামী জীবনদেবতা অন্তরতম রূপে কবির আদর্শ; কবির জীবনসত্য। 


ট) পবিত্রতা : বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও কবি একে আধ্যাত্মিক রাজ্যের বিষয় বলেছেন।
 (শিক্ষা, শিক্ষার মিলন)

ঠ) পূজা : চৈতালি কাব্যের ‘পুণ্যের হিসাব’ কবিতায় আছে, ‘যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।’ জীবনের আনন্দ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য আনন্দরসের আস্বাদনই পূজা। বিশ্বময়ীর পূজাও এটি। ‘নৈবেদ্যে’র ৭ সংখ্যক কবিতায় এই ধারণাই আছে।

ড) দেবতাভাবনা : কবির দেবতাভাবনায় মর্ত্যজীবন অঙ্গীভূত হয়েছে। বলাকার ২৪ সংখ্যক কবিতায় কবি জীবনবাদী। বলেছেন, 

‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।’

 কিংবা ‘ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার।’ তবে কবি সংসার বিমুখ নন। মায়াবাদী, মুক্তিবাদীও নন। মর্ত্যপ্রীতি তাঁর মজ্জাগত। জীবনের ধ্যানমন্ত্রই তাঁর আরাধ্য দেবতা। ‘কবির আরাধ্য দেবতা তত্ত্বোপলব্ধির দিক থেকে তিনি হচ্ছেন ‘সর্বজনীন সর্বকালীন মহামানব,’ আর অনুভূতির দিক থেকে তার প্রকাশ বিচিত্র, কবি তাই বিচিত্র নামে তাকে অভিহিত করেছেন। কখনো তিনি ‘মানসী’, ‘মানস-সুন্দরী’, ‘লীলাসঙ্গিনী’, আবার কখনো বা ‘প্রভু’, ‘প্রিয়’, ‘অন্তর্যামী’, ‘জীবননাথ’ ইত্যাদি। এককথায় বলা যেতে পারে তিনি কবির ‘জীবনদেবতা’। এই জীবনদেবতার সঙ্গেই তার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা মিলন-বিরহের বিচিত্র সম্পর্ক বা রসের সম্পর্ক। তিনি কবির প্রেমিকও বটেন, আবার তাঁর জীবনের অধীশ্বরও বটেন।’(মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম, পৃ. ২১৬)


ঢ) সংগীত ও আধ্যাত্মিকতা : রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা বিবেচনায় সংগীতের গুরুত্ব সকলেই স্বীকার করেছেন। তাঁর অনেক গান আমাদের(খ্রিস্টীয়) উপাসনালয়ে গীত হয়। ‘

গীতবিতানে’র পূজাপর্যায় গানের সংখ্যা ৬১৭। এসব গানে অভিব্যক্ত হয়েছে কবির ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা ও আত্মনিবেদনের আকুতি। যেমন একটি গান, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি/ গানের সুরে।’ অথবা ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি তখন তারে জানি।’ গানের ভেতর আছে হৃদয়ের সকল দৈন্য ঢেলে দেবার প্রেরণা, ঈশ্বরকে ভালোবাসার জোয়ারে আবগাহন করার আর্তি, অন্তর্যামীর অপ্রত্যাশিত দানের জন্য তাঁর চরণ স্পর্শ করে থাকার আকাঙ্ক্ষা। সরল, মর্মস্পর্শী অন্তর্যামীর প্রতি নিবেদিত এরকম পঙ্ক্তিমালা হলো :
‘সংসার যবে মন কেড়ে লয় জাগেনা যখন প্রাণ
তখন হে নাথ প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান।
অন্তরযামী ক্ষমো সে আমার শূন্য প্রাণের বৃথা উপহার
পুষ্পবিহীন পূজার আয়োজন ভক্তিবিহীন তান।
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে আশা করি প্রাণপণে
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে আসে মনে
সহসা একদা আপনা হইতে ভার দিবে তুমি তোমার অমৃতে
এই ভরসায় করি পদতলে শুষ্ক হৃদয় দান।’
শান্তিনিকেতনের মন্দিরে প্রত্যুষ ও সান্ধ্য উপাসনায় অনেকগুলো গান গাওয়া হতো। এমনকি পৌষোৎসবের উদ্বোধনের সময় কবির উপাসনার পর আশ্রম বিদ্যালয়ের বালকরা কবির গান গাইত। একটি বর্ণনা, ‘প্রথম সংগীতের পর এবং স্বাধ্যায়ের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ব্রহ্মসংগীতাবলী হইতে একটি গান গাহিলেন। সংগীতটি যেন উৎসব-উৎসকে একেবারে খুলিয়া দিল। ইহার পর আশ্রমের বালকবৃন্দ কয়েকটি মনোরম সংগীত গান করিলেন। সেগুলি সমস্তই ঐ ভক্ত কবির নব-রচিত।’ (রবিজীবনী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৮৬-৮৭) এর ভেতর
 ‘গীতাঞ্জলি’র অনেকগুলো গান ছিল। ‘গীতাঞ্জলি’র ভুবন প্রভুময় ভুবন, ঐশ্বরিক বোধ তার আদ্যন্ত ছড়ানো। মূলত ভারতবর্ষে মধ্যযুগে কবীর, দাদু, মীরাবাই গানের মধ্য দিয়ে অধ্যাত্মসাধনার গভীর তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সেই ধারার শ্রেষ্ঠ শিল্পী।
এ ছাড়া ‘সামাজিক সম্পর্ক’ অধ্যাত্মচেতনার গুরুত্বপূর্ণ দিক। পরিবার ও বন্ধুত্ব একজন ব্যক্তির নিজের আবেগকে সকলের সঙ্গে বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে দেয়। অসুস্থ মুহূর্তে অপরের ভালোবাসা চিন্তামুক্ত রাখতে সহায়তা করে। এটিও আধ্যাত্মিকতার সোপান। রবীন্দ্রনাথ কখনো নেতিবাচক বা হতাশাগ্রস্ত মানুষের প্রতিমূর্তি ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, মানুষের ইতিবাচক জীবনাচরণের জন্য ‘আশা’ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আলো ও আশার প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা বারবার বলেছেন। এ ক্ষেত্রে ‘ক্ষমা’ ছিল তাঁর মুখ্য অবলম্বন। ক্ষমা নিজেকে শত্রুমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। অতীত আঘাতের অপমানবোধ বা অসন্তুষ্টি থেকে মুক্ত রাখে। ক্ষমা করলে নিজের রাগ কমে আসে, মানসিক চাপ কমে। তাই কবি ক্ষমাকে তাঁর জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছিলেন। অবশ্য আধ্যাত্মিক জীবনের দুটি বাধার কথাও বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বাসের অভাব অর্থাৎ চিত্তের অবিচলিত ভরসার অভাব। আর সাধনার অনভ্যাস বা নিষ্ঠার অভাব। এ দুটি থেকে মুক্ত হলে প্রকৃত অধ্যাত্ম জীবন সম্ভব।
আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে মানুষের চাওয়া কী? এর ফলে মানুষ কি শুচি হয়ে ওঠে? তার অভীষ্ট দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে কি? আসলে যিনি ব্রহ্ম, যিনি সকলের বড় তাকেই মানুষের সামনে লক্ষরূপে স্থাপন করলে মানুষের মন তাতে সায় দিতে পারে। দুঃখনিবৃত্তি অধ্যাত্মজীবনের পরম লক্ষ নয়। বরং বড় হওয়ার ইচ্ছা, মহৎ হওয়ার ইচ্ছাই আধ্যাত্মিকতা সম্ভব করতে পারে। ধর্মসাধনা করলে হৃদয় কোমল হয়, চারিত্রিক তীব্রতা মাধুর্যে পরিণত হয়। ধর্মসাধনার অন্তরালে সুন্দর লুকিয়ে থাকে। তাকে আবিষ্কার করতে হলে ধ্যান, উপাসনা, প্রার্থনা দরকার। এসবই রবীন্দ্রনাথের চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।


কবির আধ্যাত্মিক সাধনা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে হিন্দু সমাজের লোকাচার ও ধর্মসংস্কার ত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ১৮৯১ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মন্দির বা মঠের প্রতিষ্ঠা হয়। নতুন মন্দির তথা ব্রহ্মমন্দিরের দ্বার জাতি ধর্ম অবস্থা নির্বিশেষ সকল শ্রেণির ও সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ব্রহ্মোপাসনার জন্য উন্মুক্ত হয়। 


মানবিক সত্য ও আস্তিক্যবাদ রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদের সারকথা। জগৎ ও জীবন তাঁর কাছে রূপাতীত, লোকাতীত, অনন্ত দেশকালব্যাপী এক মহান আনন্দশক্তির প্রকাশ। সুন্দর, মহনীয়, অপরূপ ও অনির্বচনীয় সবকিছু কবির আরাধ্য। তিনি সবকিছুর ভেতর ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। এটিই তাঁর বড় আধ্যাত্মিকতা।


জাতি, বর্ণ, বংশ, ভাষা জনতার মধ্যে বিভেদকে মানেননি রবীন্দ্রনাথ। সমস্ত বিশ্বকে এক পরিবার মনে করা, দেবতাজ্ঞানে পূজা করা সার্বজনীনতা। সব ধর্মই সত্য। অন্যের ধর্ম আমার নিজের ধর্মের মতোই প্রিয়। মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ থাকবে না। তবেই না সার্বজনীন চেতনার প্রসার ঘটবে। হৃদয়ের শুদ্ধতা, সহিষ্ণুতা, করুণা ও দয়ার মাধ্যমে জীবনকে দেখতে হবে। আধ্যাত্মিকতার ভেতরে যে সত্য আছে তা কোনো বিশেষ ধর্মের পরিপোষক নয়। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর পরম। একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়।
পূর্বেই বলা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হলেও তাঁর আধ্যাত্মিকতার উপলব্ধি সেই গণ্ডির বাইরে ছিল। ১৩১৫ সালে শান্তিনিকেতনে মাঘোৎসবের ভাষণে তিনি ‘ব্রাহ্মোৎসব’কে ‘ব্রহ্মোৎসব’ আখ্যা দান করেন। কোনো সম্প্রদায়ের উৎসব না হয়ে মানবসমাজের উৎসব হয়ে ওঠে তা। বিশেষ ধর্মের মধ্যে সীমায়িত ছিল না তাঁর আধ্যাত্মিকতা। ধর্মসমন্বয় ও জাতিসমন্বয়ের কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে।

 রবীন্দ্রজীবনী রচয়িতা প্রভাতকুমার বলেছে, ‘
তাঁর ধর্ম মানবতার ধর্ম-কর্মে কঠোর, জ্ঞানে উজ্জ্বল, ভক্তিতে রসাপ্লুত, সৌন্দর্যে সমন্বিত।’(পৃ. ২৬৭)

 প্রবোধচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা সম্পর্কে বলেছেন
, ‘রবীন্দ্রনাথ সেই ধর্মকেই চেয়েছিলেন যাতে জ্ঞান প্রেম ও কর্ম মিলিত হয়েছে, যাতে উপনিষদের সত্যসাধনা, বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী-করুণা এবং বৈষ্ণব ও খ্রিস্টধর্মের প্রেমভক্তি একত্র সমন্বিত হয়েছে, অথচ যা সর্বতোভাবেই আধুনিক শিক্ষিত মনের উপযোগী। 

সে মন একান্তভাবেই সাম্প্রদায়িক ভেদবিভেদ, আচারপদ্ধতি ও আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী।’
মূলত মানুষের ইন্দ্রিয় মন ও আত্মার পরিপূর্ণবিকাশ ধর্মজীবনের আদর্শ।
 রবীন্দ্রনাথের ধর্মজীবন বা আধ্যাত্মিকতা ছিল সেই আদর্শের চূড়ান্ত নিদর্শন। ‘গীতালি’র প্রথম গানটি স্মরণ করুন :
‘এতদিনে জানলেম
  যে কাঁদন কাঁদলেম
         সে কাহার জন্য।
ধন্য এ জাগরণ,
      ধন্য এ ক্রন্দন,
          ধন্য রে ধন্য।’
কবির এই উপলব্ধিরই অন্য নাম আধ্যাত্মিকতা।





Monday, December 5, 2022

#Aunt Jennifer's tiger of summarize easy learn

 Easy to learn Aunt Jennifer's tiger summarize 


The interplay between rebellion and repression has made the poems interesting. This poem underscores the theme of power and social status. Aunt Jennifer is assigned the role of an aunt. She has no independent identity. In the poem, her name is mentioned four times, and on every occasion, she is an aunt. This imposition has fragmented her role.


        This poem identifies the problems of  Women in society. The male-dominant society subordinates women. So they have nothing to do but Continue the roles impose on them by their male counterparts. Aunt Jennifer is the representative of these ill-fated women. Marriage as an institution doesn't support them. It rather ensures their eternal bandage. That's why the wedding ring is inseparable from Jennifer's life. 

                   The final stanza points to the contrast between the fearless tigers and the lifeless aunt. In fact, Through this contrast, Rich is stressing the basic idea of feminism. According to feminism, women are deprived of equal status because of social strictures and repressions. The tigers are beyond. these norms, but Jennifer's is confined within them

News

features

Best Depression caption sad caption

 Sometimes we are unable to take a good decision but our mind setup have already been upset.something wrong always broken mind or heart atta...

Labels,Feed,Sider

news (16) features (15) feed (15) sider (9) sea (4)

Main Slider


 List Of Talent Examples for a fiver /up work  of any kind online work

 Best Artistic Talents 2023

1. Graphic Design  Graphic designers are artists who use digital technology to create their artworks, which often end up on advertising materials or even television shows and video games.

2. Painting – This can be broken down into fine art painting, interpretive painting, modern art, and so on.

3. Comedy Comedians need to be able to read the room, deliver a joke at the right pace and tone, and of course have an excellent sense of observational humor.

4. Dancing Some people are naturally talented dancers while others struggle with this! You can also include formal dance here like ballet or salsa dance.

5. Acting – Actors have the talent of taking on a character persona and sticking to it during a conversation or, more commonly, during a play, film, or television show.

This list of talent examples is by no means a complete list. There are countless talents out there. Anything that you appear to be naturally good at could be a talent of yours. Once you’ve listed your best talents, you can get a better sense of who you are and how you might be able to show off your greatest aptitudes and abilities to teachers, employers, friends, and family.




Tags

news (16) features (15) feed (15) sider (9) sea (4)

Header Ads

5/Label/small-col-left

Recent

5/recent-posts

Comments